স্বপ্ন পূরণের দোরগোড়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৪৬
ছবি : বাংলাদেশের খবর
কুড়ি বছর পেরিয়ে একুশে পদার্পণ করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। পুরান ঢাকার এই প্রতিষ্ঠান শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, বরং দাবি আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের জন্যেও পরিচিত। স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও এখন একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। তবে ভর্তির প্রথম বর্ষেই আবাসন, শিক্ষার মান, গবেষণা প্রকল্প, লাইব্রেরি সুবিধা, ক্যান্টিনে ভর্তুকি, ছাত্র সংসদ নির্বাচন, বিশেষ বৃত্তি প্রদানসহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিভিন্ন প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা ইউজিসির বক্তব্য সবসময় আশ্বাসের এবং প্রতিশ্রæতির বিজ্ঞপ্তিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। গত বছরও তাদের যেসব দাবি শুধুই স্বপ্ন ছিল, এখন তা পূরণের দোরগোড়ায়। দাবি আদায়ে স্মারকলিপি জমা দেওয়া, সংবাদ সম্মেলন, উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও, তালা ঝুলিয়ে শাটডাউন ও অনশন, সচিবালয় ঘেরাও এবং লং মার্চ টু যমুনা কর্মসূচি করেছেন শিক্ষার্থীরা। এসব আন্দোলন-কর্মসূচির মুখেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ইউজিসি কিংবা শিক্ষামন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের দাবি মানতে বাধ্য হয়।
ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরের বছর, ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল। পরবর্তীতে ১৮৭২ সালে মানিকগঞ্জের জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর বাবার নামানুসারে নামকরণ হয় ‘জগন্নাথ স্কুল’। ২০০৫ সালে আন্দোলনের মুখে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাসের মাধ্যমে এটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে মোট সাতটি অনুষদের অধীনে ৩৮টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।
হল বেদখল ও আন্দোলন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘদিনের সমস্যা হলো আবাসন সংকট। ১৯৮৫ সালে স্থানীয় ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জবির ১২টি হল দখল করে নেয়।
২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরও আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হল উদ্ধারের দাবিতে আন্দোলনে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে, যাতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৭ জানুয়ারি হল আন্দোলন দিবস পালিত হয়। ২০১৪ সালের হল আন্দোলনে পুলিশের হামলায় এক শিক্ষকসহ অনেক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন।
২০১৬ সালের আগস্টের তীব্র হল আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নে ২০০ একর জমির ওপর নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণের ঘোষণা দেন।
কচ্ছপ গতির কাজ দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে
দীর্ঘ আট বছর পেরিয়েও দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীর নিকট হস্তান্তরের দাবি ‘তুলে সব শালারা বাটপার, আর্মি হবে ঠিকাদার’ স্লোগানে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টার আশ্বাসে তারা ফিরে আসে। কাজ হস্তান্তরে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেওয়ায় ২০২৫ সালের ১২ জানুয়ারি শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন শুরু করে। অসুস্থ অবস্থায় হাতে স্যালাইন নিয়েও সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেয়।
৩৫ ঘণ্টা পর লিখিত অঙ্গীকার পেয়ে তারা অনশন ভাঙে এবং ১৬ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর কাছে কাজ হস্তান্তরের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। বর্তমানে বাণী ভবন ও হাবিবুর রহমান হলের জায়গায় অস্থায়ী আবাসনের কাজ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছে।
যমুনার আন্দোলন
৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন বৃত্তি কার্যকর, প্রস্তাবিত বাজেট কাটছাঁট না করে অনুমোদন এবং দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের দাবিতে ২০২৫ সালের ১৪ মে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা লং মার্চ টু যমুনা কর্মসূচি শুরু করেন। পুলিশি হামলায় ৫০ জনের বেশি আহত হলে শিক্ষার্থীরা এদিনটিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কালো দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। টানা ৫৬ ঘণ্টা অবস্থান, অবরোধ ও অনশনের পর ১৬ মে ইউজিসি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়।
জকসু ও সম্পূরক বৃত্তি
১৯৫৪ সালে প্রথম এবং স্বাধীনতার পর ১৯৮৭ সালে সর্বশেষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন (জকসু) অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর জকসু নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে।
শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে গত ২ জানুয়ারি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং গত ১৭ সেপ্টেম্বর জকসুর সম্ভাব্য রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়। রোডম্যাপ অনুযায়ী, আগামী ২৭ নভেম্বর জকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একইসাথে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ৩ দাবিতে ৫ জন শিক্ষার্থীর অনশনের ফলে ৮ অক্টোবর সম্পূরক বৃত্তির আবেদনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রশাসন।
শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে ৭০০ শিক্ষার্থীর জন্য অস্থায়ী আবাসনের সুবিধা নিশ্চিত হয়।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রায় ৪৯ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়ে ২৯৭ কোটি ৮২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা হয়। এই বাজেটে ৫৬ কোটি টাকা সম্পূরক বৃত্তি খাতে এবং প্রথমবারের মতো থিসিস ও গবেষণায় ১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এছাড়া বাণী ভবন ও হাবিবুর রহমান হলের জায়গায় অস্থায়ী আবাসনের কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী।
কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিনা শরমীন বলেন, শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত আন্দোলন, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রচেষ্টাতেই এই সাফল্য এসেছে। বিশেষ বৃত্তি বা জকসুর রোডম্যাপ- সবই আন্দোলনের ফল। সঠিক সময়ে জকসু নির্বাচন হবে বলে তিনি আশাবাদী। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরেই জবি এখন স্বপ্ন পূরণের দোরগোড়ায়।
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যা কিছু অর্জন তা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তাদের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা ছাড়া এগুলো প্রশাসন করতে পারত না তিনি আরও বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকার অন্যতম একটি। শিক্ষা ও গবেষণায় উন্নতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অফ এক্সেলেন্স হিসেবে গড়ে তোলা আমাদের প্রতিজ্ঞা। সে লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষা ও গবেষণা, শিক্ষার্থীদের আবাসন ও দ্বিতীয় ক্যাম্পাস বাস্তবায়ন আমাদের অগ্রাধিকার। সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় আমরা সফল হবো সেই আশাবাদী।
এমএইচএস



