Logo

বিশেষ সংবাদ

জামায়াত আমিরের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা ইতিবাচক

Icon

এম. ইসলাম

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৫১

জামায়াত আমিরের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা ইতিবাচক

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধসহ ঐতিহাসিক নানা পটভূমিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার বিষয়ে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে ক্ষমা চাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ইতোপূর্বে ঐতিহাসিক নানা ভূমিকার বিষয়ে পরিষ্কার বার্তা না থাকায় তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশের দলটির বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। সেখান থেকে দলটি বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান অতীতের কর্মকাণ্ডে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে। কারণ, কিছুদিন পরেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার আগে জামায়াত আমিরের এ বক্তব্য রাজনীতিতে বিশেষ বার্তা বহন করে বলে মনে করা হচ্ছে। জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে জামায়াত ও দলটির ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের বেশ ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। সেটিকে কাজে লাগিয়ে দলটি এখন এগোতে চাইছে। দলের বড় একটা অংশ এখন ১৯৭১ পরবর্তী প্রজন্ম।

নতুন এই প্রজন্ম জামায়াতকে গতানুগতিক ধারা থেকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। দলটি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এবার অমুসলিম শাখা চালু করেছে। এমনকি ভালো প্রার্থী পেলে অমুসলিমদের প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। বর্তমানে বিভিন্ন সেক্টরে নিজেদের জনবল তৈরির কাজ জোরেশোরে করছে জামায়াত। চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দলটি এবার অমুসলিম এবং বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রার্থীর সমন্বয়ে প্যানেল দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে।

জানা গেছে, গত বুধবারের (২২ অক্টোবর) বক্তব্যে শফিকুর রহমান বলেন, কেবল একাত্তরের ভূমিকার জন্য নয়, সাতচল্লিশের ভারতভাগ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কোনো ‘ভুল’ করে থাকলে তার জন্য শর্তহীনভাবে ক্ষমা চাইছে জামায়াত।

তিনি বলেন, একাত্তরে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতার প্রত্যাশাকে তখনকার জামায়াত নেতৃত্বের ‘সম্মান করা উচিত’ ছিল। তবে তারা কেন করেননি, তা নিয়ে কথা বলার উপযুক্ত ব্যক্তি তিনি নন, কেননা তিনি তখন ছিলেন না।

তিনি বলেন, আজকের দিন পর্যন্ত আমরা ভুল করি নাই- এ কথা বলব কীভাবে? আমরা মানুষ, আমাদের সংগঠন একটা মানুষের সংগঠন; আমাদের একশটার মধ্যে ৯৯টা ডিসিশন সঠিক, একটা তো বেঠিক হইতে পারে। সেই বেঠিক ডিসিশনের জন্য জাতির তো কোনো ক্ষতিও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমার কোনো ডিসিশনে জাতির ক্ষতি হলে আমার মাফ চাইতে অসুবিধা কোথায়?

তার এ বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। কেন জামায়াত আমির হঠাৎ ক্ষমা চাইলেন? 

সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে দৈনিক বাংলাদেশের খবর। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলটির নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে।

তবে, দলটিতে গণতান্ত্রিক পন্থায় নেতৃত্ব নির্বাচন, তৃণমূলের নির্দেশনা মানার প্রবণতা এবং তুলনামূলক অনিময়-দুর্নীতির বাইরে থাকার ইতিবাচক বিষয়ে বেশির ভাগ বিশ্লেষক বা সাধারণ মানুষের দ্বিমত নেই। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, জামায়াতে ইসলামীতে কর্মীদের মধ্যে শৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি বা অনিয়য়ে জড়ানোর প্রবণতা খুব কম। তবে, দলটির ইতোপূর্বের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীতে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার না। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে দেশভাগের বিরোধিতা করা বাদ দিলাম, ১৯৭১ সালে তাদের অবস্থানের জন্য একবার ক্ষমা চাওয়া বা অবস্থান পরিষ্কার করতে দেখলাম না। এবার দলটির আমির ক্ষমা চাইলেও সেখানে ‘যদি’ রয়েছে।

তিনি বলেন, তারপরও জামায়াত বুঝতে পারছে তাদের অতীতের ভূমিকার জন্য বিশেষ করে তরুণ সমাজ নেতিবাচক। তাই তারা একেবারে পাশ না কাটিয়ে ক্ষমা চাইছে; যা ইতিবাচক। তিনি মনে করেন, এখন যারা দলটির কর্মী, সমর্থক, অনুসারী কিংবা নেতা; তারা রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধী ট্যাগ কেন নেবেন। কারণ, এখনকার তরুণ নেতৃত্বের অনেকের জন্ম ১৯৭১ সালের পরে হয়েছে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ড. আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, জামায়াতের জনসমর্থন তুলনামূলক আগের চেয়ে বেড়েছে। গণতন্ত্র চর্চাসহ দলটির অনেক ইতিবাচক দিক এবার সরকার পতনের পর প্রমাণিত হয়েছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াতকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের আগে বিএনপির বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগকে সুযোগ করে দিয়ে দলটি ভুল করেছিল। এ ছাড়া ঐতিহাসিক বিষয়গুলোতে দলটি সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণা রয়েছে সে বিষয়ে বার্তা আরও পরিষ্কার হওয়া উচিত ছিল। হয়তো সেই বোধোদয় থেকেই দলটির আমির কথা বলেছেন। ওভারঅল বিষয়টি ইতিবাচক।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে জামায়াতের সমালোচনা করার মতো কিছু নেই। জামায়াত ইসলামী করাপশন ও চাঁদাবাজি করে না। এ বিষয়ে আমাদের ঘায়েল করার কোনো সুযোগ নেই। জামায়াত শতভাগ গণতান্ত্রিক দল এটি নিয়েও কোনো বিভ্রান্তি নেই। জামায়াতের সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু না পেয়ে অনেকে আগের নানা বিষয় সামনে নিয়ে আসেন। 

তিনি বলেন, ঐতিহাসিক বিষয়গুলোতে অনেকে কেন জামায়াতকে নিয়ে বক্তব্য দেয় সেটি এখন মানুষের কাছে পরিষ্কার।

প্রতিষ্ঠা, বিতর্ক ও বর্তমান অবস্থান: ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট আবুল আ’লা মওদুদী লাহোরে ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে জামায়াত অখণ্ড ভারত ধরে রাখতে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর জামায়াতে ইসলামী ভারত ও পাকিস্তান দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। আইয়ুব খানের মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করায় ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলেও পরবর্তীতে তা  তুলে নেওয়া হয়।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে জামায়াত ইসলামী বিরোধিতা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দলটি বিরোধিতা করেছিল। পাকিস্তান ভাঙার জোরালো বিরোধিতায় দলটির সে সময়ের অনেক নেতা শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর গঠনে নেতৃত্ব দেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। পাকিস্তান ভাঙার পর দলটির পূর্ব পাকিস্তান শাখাটি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামে রূপান্তরিত হয়।

স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হলে স্বাধীনতার পর জামায়াত ইসলামী নিষিদ্ধই থাকে। তখন গোলাম আযমসহ জামায়াতের কিছু নেতা পাকিস্তানে চলে যান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের আগস্টে জিয়াউর রহমান সরকার সব দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে অধ্যাদেশ ঘোষণা করে। আবারও রাজনীতিতে আসে জামায়াত। এরপর গোলাম আযম দেশে ফেরার পর ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ হিসেবে রূপ লাভ করে। দলটি ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং কম-বেশি প্রতিনিধিত্ব পায়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দলটির নেতাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে। আদালতের রায়ে ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়। নেতাদের বিচারের বিরোধিতা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার দাবিতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দলটির দেশব্যাপী আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। অবশ্য ২০১৪ , ২০১৮ ও ২০২৪-এর একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে জামায়াতকে রাজনৈতিক কোনো ‘স্পেস’ দেয়নি আওয়ামী লীগ। বরং ক্ষমতায় এসে দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় কার্যকর করা হয়।

সবশেষ ২০২৪ সালের ১ আগস্ট সরকার জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতনের পর ২৬ দিনের মাথায় সেই আদেশটি প্রত্যাহার করে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

বর্তমানে সারা দেশে জামায়াতের বেশ শক্ত সাংগঠনিক কার্যক্রম রয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ওয়ার্ড বা ইউনিট পর্যায়েও রয়েছে দলটির কর্মকাণ্ড। দলটির তৃণমূলেও রয়েছে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ। দলটির কর্মী বা সমর্থকরা অনেক দলের থেকে বেশি শৃঙ্খল বলে মনে করা হয়। আগামী নির্বাচনে দলটি বিশেষ চমক দেখাতে চায় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী জামায়াত আমির

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর