পাঠ্যবইয়ের ছাপাখানায় চলবে দুদকের অভিযান
তরিকুল ইসলাম সুমন
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৫০
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর ক্ষেত্রে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহারের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। এরই ধারাবাহিকতায় একাধিক ছাপাখানায় অভিযান পরিচালনা করে দুদক। একই সঙ্গে অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। ফলশ্রুতিতে এখন পর্যন্ত বিনামূল্যে বিতরণের এসব বই মুদ্রণে অনিয়মের আশ্রয় নেওয়ায় ২২টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। নিম্নমানের ছাপা ও মুদ্রণত্রুটির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের ৬০ লাখ বই এবং চার লাখ বইয়ের ফর্মা নষ্ট করেছে এনসিটিবি।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বই ছাপার কাজ ইতোমধ্যে ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। দ্রত ছাপার কাজ শেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। আটটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে শোকজও করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে বলা হয়েছে নি¤œমানের কিনা সেটি চেক করে বই গ্রহণ করতে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, এনসিটিবির আওতায় নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রেক্ষিতে এনসিটিবি কার্যালয়ে এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর পরিদর্শন করে এবং এনসিটিবি থেকে প্রাসঙ্গিক রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের উপপরিচালক মো. আক্তারুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক পর্যালোচনায় টিম দেখতে পায়, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণে নানা অনিয়ম হয়েছে। বিশেষ করে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার, মুদ্রণ মানের ঘাটতি, বাঁধাই ত্রুটি এবং কিছু মুদ্রণ প্রেসের মালিকদের সঙ্গে অসাধু যোগসাজশের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাতের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে। দুদকের মাধ্যমে এ ধরনের অভিযান চলবে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপাতে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে বেশির ভাগ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। দরপত্র না মেনে নিম্নমানের বই ছাপানোর কারণে ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠিও দিয়েছে। গত বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ১১৬টি প্রেস বই ছাপার কাজ পায়। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরে ইন্সপেকশন এজেন্সির প্রতিবেদনে ২৯টি প্রেস নিম্নমানের বই দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে সৃষ্টি প্রিন্টার্স, কচুয়া প্রেস, অনন্যা প্রিন্টার্স, অটো প্রিন্টিং প্রেস, অগ্রণী প্রিন্টার্স, সরকার প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিকেশন এবং কর্ণফুলী প্রিন্টার্সসহ আরও কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নি¤œমানের বই ছাপানোর অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, অস্পষ্ট ছাপা ও মুদ্রণের মারাত্মক ত্রুটির কারণে চার প্রতিষ্ঠানের বই নষ্ট করা হয়। এর মধ্যে সোনালী ওয়েব প্রিন্টার্সের প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণির আট হাজার ৮০০ বই, অক্সফোর্ড প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন দুই শ্রেণির ৩৭ হাজার ৪০০, রেদওয়ানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের দুই শ্রেণির তিন হাজার ৪৭৮ ও অনিন্দ্য প্রিন্টিং প্রেসের তৃতীয় শ্রেণির ১৫০টি বই নষ্ট করা হয়েছে। এছাড়া মুদ্রণমান খারাপ হওয়ায় আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বই ও ফর্মা বিনষ্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে বর্ণমালা প্রেসের দ্বিতীয় শ্রেণির ২২ হাজার ৭০০ ফর্মা, ন্যাশনাল প্রিন্টার্সের ১০ হাজার ১০০ ফর্মা, মেরাজ প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের চতুর্থ শ্রেণির ৫০০ ফর্মা, রিফাত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের চতুর্থ শ্রেণির ৩৫ হাজার ফর্মা, ফাইভ স্টার প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের দুই শ্রেণির ১৯ হাজার বই ও ফর্মা, সীমান্ত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের তৃতীয় শ্রেণির ১৪ হাজার বই ও ফর্মা, নূরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেসের তৃতীয় শ্রেণির পাঁচ হাজার ফর্মা, সরকার প্রেসের প্রথম শ্রেণির ৪৯ হাজার ফর্মা ও দ্বিতীয় শ্রেণির ৫৮৪টি বইয়ের ইনারের প্রথম পৃষ্ঠা, শাফিন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের দুই হাজার ফর্মা ও বর্ণালি অফসেট প্রিন্টার্সের ৩২ হাজার ৩৯৫ হাজার পৃষ্ঠা বিনষ্ট করা হয়। সমতা প্রিন্টিং প্রেসের একটি ফর্মায় রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত সমস্যা পাওয়া গেছে।
একইভাবে মাস্টার সিমেক্স পেপার লি. ও প্রমা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্সসহ বেশ কিছু প্রেসের বিরুদ্ধে এবারও নিম্নমানের বই দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে নিম্নমানের বই ছাপানোয় শোকজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস, সরকার প্রেস (দুইবার), নাহার প্রেস, মহানগর প্রেস, দশদিশা, রেজা প্রিন্টার্স (দুইবার) ও টাঙ্গাইল অফসেট প্রেস।
অভিযুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠান বিগত সময়েও শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের বই দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রমা প্রিন্টার্সের মালিক এসএম মহসিন বলেন, এ ধরনের অভিযোগ সত্য নয়।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক স্তরের মোট বইয়ের প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি বই প্রিন্ট হয়েছে। আর ৪০ শতাংশ বই বিতরণের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। আমরা বইয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করতে কাজ করছি। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করা হয়েছে।
এদিকে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা উপকরণ পিডিআই কার্যক্রম পরিচালনার কাজ পেয়েছে ‘ইনফিনিটি সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন (বিডি)’ এজেন্ট। গত ১৩ অক্টোবর অ্যারিস্টোক্রেট্স সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের নিম্নমানের ১৩ মেট্রিক টন কাগজ রিজেক্ট করে এই এজেন্ট। এ কারণে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম নজরুল ইসলাম ফোন করে এজেন্টকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। তিনি প্রতিকার চেয়ে এনসিটিবির কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক মো. সাহতাব উদ্দিন বলেন, আমরা প্রতিদিন প্রেসে গিয়ে পরিদর্শন করছি। কোনো অসংগতি পেলে ব্যবস্থা নিচ্ছি। বই ছাপার প্রশ্নে অনিয়মের কোনো ছাড় নেই। আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরে প্রায় আট কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার এবং মাধ্যমিক স্তরে ২১ কোটি ৪০ লাখ বই বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বিতরণ করা হবে।
এদিকে গত ২১ সেপ্টেম্বর আগামী শিক্ষাবর্ষের নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের বিষয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হলেও দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের কারণে অনুমোদন দেয়নি সরকার। পরে তা আরও যাচাই-বাছাই করার নির্দেশনা দেয় ক্রয় কমিটি। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে গত মঙ্গলবার মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) নবম শ্রেণি, দাখিল নবম শ্রেণি, এসএসসি ও দাখিল (ভোকেশনাল) নবম শ্রেণি এবং কারিগরি ট্রেড নবম ও দশম শ্রেণির বিনামূল্যের পাঁচ কোটি ৫৪ লাখ ৯০ হাজার ৮৬৯টি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের অনুমোদন দেয় সরকার। যদিও সেদিন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে বইয়ের আলোচ্য বিষয়টি নথিভুক্ত করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একটা বিশেষ মহলকে সুবিধা দিতে এই ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত বছর ৪০টির মতো ছাপাখানা ‘নি¤œমানের’ পাঠ্যবই সরবরাহ করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে বই সরবরাহও করতে পারেনি। কিন্তু নানা মহলের তদবিরের চাপে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি ও বৈষম্যবিরোধী মুদ্রণ ব্যবসায়ী নেতা তোফায়েল খান বলেন, প্রাক প্রাথমিক বই ছাপার কাজ অনেকটা এগিয়েছে। নতুন করে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপা কিছুদিন আগে সরকারি ক্রয় কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। এখন ছাপা শুরু হবে। তবে চাপ বেশি থাকায় একটা অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে। মাধ্যমিকের বই ছাপাতে সময় কম পাওয়া যাবে। এ কারণে নির্ধারিক সময়ে বই সরবরাহ করা সম্ভব নাও হতে পারে।
জানা গেছে, ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের সংখ্যা চার কোটি ৪৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৬, সপ্তম শ্রেণির চার কোটি ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯২ এবং অষ্টম শ্রেণির চার কোটি দুই লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮টি। মাধ্যমিকের মোট ২৮০টি লটের মধ্যে ১১ কোটি ৮৯ লাখ বই ছাপানোর দরপত্র বাতিল হয়েছে। যার মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬০৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের মোট পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে আট কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার।
অপরদিকে ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের সংখ্যা চার কোটি ৪৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৬, সপ্তম শ্রেণির চার কোটি ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯২ এবং অষ্টম শ্রেণির চার কোটি দুই লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮টি বই ছাপাতে হবে।
২০২৬ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে মান নিয়ন্ত্রণে শিশুদের চোখের সুরক্ষার কথা ভেবে চিকিৎসকদের পরামর্শে প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়েছে ওবিএ-মুক্ত কাগজের শর্ত। এ ধরনের অফ-হোয়াইট বা প্রাকৃতিক রঙের কাগজ উৎপাদনে শতভাগ ‘ভার্জিন পাল্প’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এর পাশাপাশি কাগজের স্থায়িত্ব (বাস্টিং ফ্যাক্টর) ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ এবং কাগজের পুরুত্ব (জিএসএম) ৮২ থেকে ৮৫ গ্রাম করা হয়েছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো ‘অপাসিটি’। অর্থাৎ, কাগজের এক পৃষ্ঠার লেখা যেন অন্য পৃষ্ঠা থেকে দেখা না যায়। এসব শর্ত এমনভাবে একটির সঙ্গে অন্যটি যুক্ত যে, একটি মানা না হলে অন্যটিও পূরণ হবে না।
বিকেপি/এমবি


