বাংলাদেশে মুসলিম বিবাহের অন্যতম আইনি দলিল হলো কাবিননামা বা নিকাহনামা ফরম, যা মুসলিম ফ্যামিলি ল’ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১ অনুযায়ী রেজিস্ট্রার দ্বারা সংরক্ষিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত এই সরকারি ফরমটি সমাজের পরিবর্তন, নারীর অধিকার, এবং আধুনিক আইনি বাস্তবতার সঙ্গে আর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন। ফলে সময়ের দাবি অনুযায়ী কাবিননামা ফরমের সংশোধন এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যবহৃত কাবিননামা ফরমটি প্রায় ৬০ বছরের পুরোনো। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ অনুযায়ী এটি তৈরি করা হয়েছিল, যখন সামাজিক প্রেক্ষাপট, নারীর অবস্থান ও আইনি সচেতনতা অনেক ভিন্ন ছিল। তবে আজকের সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের অধিকার, সম্পত্তিতে অংশ, বিবাহবিচ্ছেদ ও খোরপোষ সংক্রান্ত নতুন বাস্তবতার কারণে এই ফরমে নানা অসংগতি ও সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ফরমে মূল সমস্যাগুলো হচ্ছে- ফরমে অনেক প্রশ্ন (যেমন- মোহরের ধরন, তালাকের অধিকার হস্তান্তর) এমনভাবে লেখা যে সাধারণ মানুষ তা বুঝতে পারেন না। ফলে প্রায়ই ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য থাকে। এছাড়া, ফরমে নারীর সম্পত্তির অধিকার, তালাক পরবর্তী খোরপোষ বা সন্তান হেফাজতের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো অংশ নেই।
এমনকি “তালাকের অধিকার” সংক্রান্ত (ঈষধঁংব১৮) অংশটিও সচেতনতা ও যথাযথ ব্যাখ্যা ছাড়া পূরণ করা হয় না, ফলে অধিকাংশ নারী এর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। নিকাহনামায় আধুনিক তথ্যের অনুপস্থিতি রয়েছে। যেমন- জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, মোবাইল নম্বর, জন্ম নিবন্ধন বা ঠিকানা যাচাইয়ের মতো মৌলিক তথ্যের জায়গা নেই- যা এখনকার প্রশাসনিক ও আইনি প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান ফরমের জটিলতা ও তথ্যের ঘাটতির কারণে অনেক সময় কাবিননামা রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ণ হয় না, যা ভবিষ্যতে আইনগত জটিলতা তৈরি করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জজ কোর্টেও এপিপি কে এম খায়রুল কবীর বাংলাদেশের খবরকে জানান, কাবিননামা হলো নারীর আইনি সুরক্ষার প্রথম নথি। কিন্তু এর অনেক ধারা এমনভাবে লেখা যে গ্রামীণ বা অশিক্ষিত পরিবারগুলো তার অর্থই বুঝে না। ফলে তারা নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না।
নারী অধিকারকর্মী ও আইনজীবী মাকসুদা বেগম বলেন, নিকাহনামা ফরমটিতে নারীর সম্মতি, পছন্দ, এবং বিবাহ-পরবর্তী দায়িত্ব ভাগাভাগি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা দরকার। এছাড়া তালাক বা পুনর্বিবাহের ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া কীভাবে হবে, সেটিও স্পষ্টভাবে ফরমে থাকতে হবে।”
নিকাহনামা সংস্কারের বিষয়ে অ্যাড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী দর্পণ বলেন, কাবিননামা ফরমে জাতীয় পরিচয় নম্বর, ছবি, ও জন্ম তারিখ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
এছাড়া নারীর তালাকের অধিকার স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে, হস্তান্তর অংশ সহজভাবে উপস্থাপন করতে হবে। বিবাহ পরবর্তী খোরপোষ ও সম্পত্তির অংশীদারিত্ব বিষয়ে তথ্য যুক্ত রাখা জরুরী। ফরমে বাংলা ভাষায় সহজ ব্যাখ্যা যুক্ত করলে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সব শ্রেণির মানুষ বুঝতে পারে। ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চালু করে কাবিননামার অনলাইন কপি সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করলে কাবিননামা বাস্তবতার সঙ্গে যে অসঙ্গতি রয়েছে তা দূর হয়ে যাবে।
কাবিননামা বা নিকাহনামা শুধু বিবাহের আইনি স্বীকৃতি নয়, এটি একজন নারীর ন্যায্য অধিকার রক্ষার প্রতীকও বটে। তাই সময় এসেছে এই প্রাচীন ফরমটি নতুন বাস্তবতা অনুযায়ী সংশোধন করার যাতে প্রতিটি নারী ও পুরুষ সমান মর্যাদায়, সচেতনতার সঙ্গে, আইনসম্মত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন।
বিকেপি/এমবি


