Logo

বিশেষ সংবাদ

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ

Icon

এম. ইসলাম

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৪

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের (এনসিসি) সুপারিশের পরও  জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নিয়ে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। কারণ, সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের দিনক্ষণ ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ তুলে দেওয়া নিয়ে বিএনপি এবং জামায়াত পাল্টাপাল্টি অবস্থানে অনড় রয়েছে।  সমরকারের কাছে সুপারিশ হস্তান্তরের পর বিএনপি কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আর জামায়াত ও সমমনারা ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে নির্বাচনের আগে নভেম্বরে গণভোট দেওয়ার দাবিতে কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে।

মঙ্গলবার সরকারের কাছে এনসিসির সুপারিশ নিয়ে গতকাল বুধবারও দিনভর বিএনপি ও জামায়াত সমমনারা পূর্বের অবস্থান পুর্নব্যক্ত করেছে। বিএনপি বলছে-গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একইদিন হতে হবে। আর জামায়াত বলছে- নির্বাচন ও গণভোট একইদিন চাওয়া মানেই হচ্ছে সনদ বাস্তবায়ন না করার চেষ্টা। জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) অভিযোগ করে বলছে- বিএনপি গণভোট চায় না।

তাই জুলাই বিপ্লবের আকাক্সক্ষা ধারণ করে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের আশা  বড় দলের বাধায় শেষ পর্যন্ত কতটা পূরণ হবে তা নিয়ে এখনো সংশয় রয়ে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন- সত্যিকার অর্থে সনদ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকার একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারলে দেশের রাজনীতিতে গুণগত মান পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। যা করার ক্ষেত্রে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরীর মতে, ঐকমত্যের বিষয়গুলোতে নোট অব ডিসেন্ট প্রত্যাহার ছিল কমিশনের উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত। নির্বাচন ও গণভোট একদিনে হওয়া সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।

বিশ্বের কোনো দেশে এমন নজীর নেই জানিয়ে তিনি বলেন, হাজারো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণঅভ্যুত্থানকে ধারণ করে রাজনীতির গতানুগতিক ধারা পরিবর্তনে অবশ্যই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে যদি বিএনপি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে বুঝতে হবে দলটি ছাত্র-জনতার রক্তের সঙ্গে বেইমানি করছে।

এদিকে, বুধবার দুপুরে বিএনপি আয়োজিত একটি গোলটেবিল বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ আমাদের হতাশ করেছে। ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, সুপারিশে কিছু দলের প্রস্তাব ও ঐকমত্য কমিশনের চিন্তা-ভাবনা জাতির ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করছি। রেফারিকে আমরা কখনো গোল দিতে দেখিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরও দু-তিনটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ। আমি বিপক্ষেই খেলছিলাম মনে হয়।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও নভেম্বরে গণভোটের দাবিসহ পাঁচ দফা দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জামায়াত ইসলামীসহ আন্দোলনরত সাতটি দল। নতুন কর্মসূচি অনুযায়ী ৩০ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। ৩ নভেম্বর শীর্ষ নেতারা সংবাদ সম্মেলনে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।

এদিকে, অবিলম্বে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও আদেশের ওপর নভেম্বরের মধ্যে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে দলসমূহের যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছে জামায়াত ও সমমনারা। জাতীয় প্রেসক্লাবে যৌথ সংবাদ সম্মেলন থেকে দলগুলো আজ বৃহস্পতিবার এ দাবিতে নির্বাচন কমিশনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া ৩ নভেম্বর পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এক অনুষ্ঠান শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তারা নির্বাচনের আগে নভেম্বর গণভোট চায়।

এদিকে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন- বিএনপি গণভোট বানচাল করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ইলেকশন কমিশনের দুইটা টেস্টিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এই গুন্ডাতন্ত্র-মাস্তানতন্ত্র মুক্তির একমাত্র উপায় হলো, গণভোটটা সুষ্ঠু যেন সম্পন্ন হয়। তারপর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে।

যদিও গণভোটের দিনক্ষণ এখনো নির্দিষ্ট হয়নি তারপরও জামায়াতসহ সমমনাদের দাবির প্রতিফলন হয়েছে সুপারিশে। আর বিএনপির চাওয়া অনেক অংশে পূরণ হয়নি। তাই দলটি ইতিমধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। কারণ, এ চ্যালেঞ্জ উত্তরণের উপর নির্ভর করছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের যে সুপারিশপত্র জমা দিয়েছে তাতে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সুপারিশ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারির দিন থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন পর্যন্ত যেকোন দিন গণভোট। দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে (পিআর) উচ্চ কক্ষ গঠন। এছাড়া গণভোটে 'নোট অব ডিসেন্ট' এর কোন উল্লেখ থাকবে না।

সুপারিশ হস্তান্তরের কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ জানিয়েছিলেন- সুপারিশে ৮৪টি প্রস্তাবকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়গুলো দ্রুত কার্যকরের প্রস্তাব রয়েছে। 

এছাড়া সংবিধান সংশ্লিষ্ট মোট ৪৮টি বিষয় বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প প্রস্তাব সরকারের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। যার একটি হচ্ছে- আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ৯ মাস সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো এই সময়ের মধ্যে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে।

বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে- যদি সংসদ তা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সংবিধান সংশোধনী আইনের খসড়া আকারে তৈরি করে বিলটি গণভোটে দেওয়া হবে। গণভোটে তা পাস হলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ মূল ভাব ঠিক রেখে প্রস্তাবগুলো অনুমোদন দেবে। আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে তা অনুমোদন না করলে এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে।

এছাড়া জুলাই সনদকে বৈধতা দেওয়ার জন্য প্রথমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভিত্তিতে একটি আদেশ জারি করা হবে। এই আদেশের শিরোনাম হবে 'জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫'।

এই আদেশের অধীনে একটি গণভোট অধ্যাদেশ জারি করা হবে, যা গণভোটের বৈধতা নিশ্চিত করবে। গণভোটে জনগণ অনুমোদন দিলে, পরবর্তী সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে হবে-একদিকে সংবিধান সংস্কার পরিষদ এবং অন্যদিকে আইনপ্রণয়নকারী সংসদ হিসেবে।

সুপারিশে আরো বলা হয়েছে- 'জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ' জারির পর থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় গণভোট করা যেতে পারে।

কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গণভোট অনুমোদিত হলে সংবিধান সংস্কার পরিষদকে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন করতে হবে। ২৭০ দিনের মধ্যে প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এবং পরবর্তী সংসদেও একই পদ্ধতি নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ ধারা রাখা হয়েছে।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

জুলাই সনদ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর