মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগ : শর্ত দিয়ে নতুন সুযোগ
তরিকুল ইসলাম সুমন
প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১০:২৭
দুই দেশের আলোচনার পর বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নতুন দ্বার খুলছে। দেশটিতে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জন্য আনুষ্ঠানিক মানদণ্ড প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়া সরকার।
বৈধ লাইসেন্সধারী রিক্রুটিং এজেন্টগুলোকে আগামী ৭ নভেম্বরের মধ্যে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্রসহ আবেদন দাখিল করার জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। গতকাল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শেফায়েত হোসেন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদল অন্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও একই সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্ট নির্বাচনের মানদণ্ড নির্ধারণ এবং তা বাংলাদেশকে অবহিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ‘রিক্রুটং এজেন্ট সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া’ পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। আগামীতে এসব অভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের রিক্রুটিং এজেন্ট ঠিক করা হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় আগে অন্য দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিকে বেশি সুযোগ দেওয়া হতো। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য ও সমতা রক্ষা করে বাংলাদেশি বৈধ লাইসেন্সধারী সব রিক্রুটিং এজেন্টকে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে বারবার তাগিদ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য নির্ধারিত ১০ শর্তগুলো হচ্ছে-
১. লাইসেন্স পাওয়ার পর অন্তত পাঁচ বছর সন্তোষজনকভাবে কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
২. গত ৫ বছরে কমপক্ষে ৩ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠানোর প্রমাণ থাকতে হবে।
৩. অন্তত ৩টি ভিন্ন দেশে কর্মী পাঠানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
৪. প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন ও নিয়োগ সংক্রান্ত বৈধ লাইসেন্স থাকতে হবে।
৫. সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সদাচরণের সনদ থাকতে হবে।
৬. জোরপূর্বক শ্রম, মানবপাচার, অর্থপাচার বা অন্য কোনো অপরাধে জড়িত থাকার রেকর্ড থাকা যাবে না।
৭. নিজস্ব প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন কেন্দ্র থাকতে হবে- যেখানে আবাসন, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা মডিউল থাকবে।
৮. অন্তত ৫ জন আন্তর্জাতিক নিয়োগকর্তার কাছ থেকে ইতিবাচক প্রশংসাপত্র থাকতে হবে।
৯. কমপক্ষে ১০ হাজার বর্গফুট আয়তনের নিজস্ব স্থায়ী অফিস থাকতে হবে, যেখানে কর্মী বাছাই ও নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়।
১০. পূর্বে মালয়েশিয়া বা অন্য গন্তব্য দেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আইনসম্মত প্রক্রিয়া অনুসরণের প্রমাণ থাকতে হবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ সব শর্ত পূরণে সক্ষম রিক্রুটিং এজেন্টদের আবেদন দাখিল করতে হবে। এরপর মানদণ্ড পূরণকারী বৈধ লাইসেন্সধারী রিক্রুটিং এজেন্টদের তালিকাভুক্ত করতে মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ জানাবে বাংলাদেশ সরকার। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শর্ত অনুযায়ী আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে তালিকা সে দেশের মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
মালয়েশিয়া সরকার বলছে, তাদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী এজেন্সির নাম দিতে হবে। শর্ত পূরণ না করলে কর্মী নিয়োগের জন্য তাদের বিবেচনা করা হবে না। এই নীতি দুই দেশের মধ্যে গঠনমূলক এবং নৈতিক শ্রম অভিবাসন অনুশীলনকে শক্তিশালী করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে বাংলাদেশিদের জন্য বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। আট বছর পর ২০১৬ সালে চালু হলেও দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে ফের বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। নতুন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে সেই শ্রমবাজার খোলে তিন বছর পর। ২০২২ সালের আগস্টে দেশটিতে আবারও বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী সর্বশেষ কর্মী গেছে গত বছরের ৩১ মে। সে সময়ে সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও শেষ মুহূর্তে প্রায় ১৭ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। তাদের মধ্যে থেকে ৭ হাজার ৮২৩ জনকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করে মালয়েশিয়ার সরকার। ইতোমধ্যে তাদের সেদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ থাকে।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বিষয়ে গত মে মাসে মালয়েশিয়া সফর করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সেখানে মালয়েশিয়া সরকারকে সব রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। সে সময় আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘আমরা অনুরোধ করেছিলাম- বাংলাদেশে যারা রিক্রুটিং এজেন্ট আছে, তারা সবাই যেন লোক পাঠানোর সুযোগ পায়, এটা আমরা অনেক ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেছি। তারা বলেছেন, এটি ভালোভাবে বিবেচনা করে দেখবেন। আমাদের অচিরেই তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে।’
এরপর পুনরায় শ্রমবাজার চালুর বিষয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের একাধিকবার আলোচনা হয়। কিন্তু নতুন করে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
এ অবস্থায় গত ২১ ও ২২ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া তৃতীয় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর মালয়েশিয়া পক্ষ বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্ট নির্বাচনের মানদণ্ড নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশকে ‘রিক্রুটিং এজেন্ট সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া’ পাঠিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার।
বিকেপি/এমবি

