ভুয়া তথ্য ও বিদ্বেষমূলক প্রচার নির্বাচনি প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিতে পারে। ঝুঁকি মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি না থাকায় বাংলাদেশে আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনীতি সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে এক গবেষণা প্রতিবেদনে।
ডিজিটাল অধিকার ও তথ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইট এ গবেষণা চালিয়েছে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এই গবেষণা চালায় ডিজিটালি রাইট। তাতে অর্থায়ন হয় যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের অর্থায়নে ‘প্রমোটিং ইফেকটিভ, রেসপনসিভ অ্যান্ড ইনক্লুসিভ গভর্ন্যান্স ইন বাংলাদেশ’ কর্মসূচির মাধ্যমে।
‘ট্যাকলিং ইলেকশন ডিসইনফরমেশন ইন বাংলাদেশ : বিল্ডিং কালেকটিভ রেসপন্সেস ফর ইলেক্টোরাল ইন্টেগ্রিটি’ শিরোনামের গবেষণাপত্রটি গতকাল রাজধানীর এক হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয়।
ডিজিটালি রাইটের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গবেষণাপত্রের বিষয়ে জানানো হয়, বাংলাদেশে অনলাইনে জনপরিসর ভীষণভাবে ভঙ্গুর ও বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালের শেষ ভাগ থেকে ভুয়া রাজনৈতিক তথ্য ছড়ানোর মাত্রা বাড়তে থাকে। তা মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে তা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। এটি নির্বাচনি প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা, সামাজিক স্থিতি এবং নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
নির্বাচন ঘিরে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির ডিজিটাল প্রচার বেড়ে যাওয়ার দিকটি তুলে ধরে গবেষণাপত্রে বলা হয়, তাতে সমর্থকদের চাঙা করতে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্যও ছড়ানো হচ্ছে। আর এই ভুয়া তথ্য ছড়ানোর জগতে বড় উপস্থিতি রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ অবস্থায় থাকা আওয়ামী লীগের।
ডিজিটালি রাইট বলেছে, রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি ধর্মীয় গোষ্ঠী, বিদেশি ও প্রবাসী একটি অংশও এক ধরনের ডিজিটাল প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর কনটেন্ট, প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্ক এবং বাণিজ্যিক কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিকৃত ছবি, মনগড়া ভিডিও ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে তৈরি কনটেন্ট নারী প্রার্থী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা নির্বাচনের আগে ভয়ভীতি, হয়রানি ও ভোটার দমন বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ভুয়া খবর এখন দেশকে অস্থিতিশীল করার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, সরকারি এক কর্মকর্তার এমন মন্তব্যও উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণাপত্রে।
এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর প্রস্তুতি আশঙ্কাজনকভাবে দুর্বল বলে দাবি করা হয় ডিজিটালি রাইটের গবেষণাপত্রে। ১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশে ফ্যাক্ট চেকার সংখ্যার অপ্রতুলতা তুলে ধরে বলা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাক্ট চেকারের সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ জন। অধিকাংশ মূলধারার গণমাধ্যমে ফ্যাক্ট চেকার নেই। সাংবাদিক ও ফ্যাক্ট চেকারদের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি কৌশল যেমন নেই, আবার তাদের মধ্যে সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনেরও এই ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত নীতি কাঠামো, দক্ষতা ও সক্ষমতা নেই। নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও নাগরিক সমাজেরও ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ চালানোর কোনো উদ্যোগ নেই।
অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন ভুয়া তথ্য মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলেন, প্রচলিত গণমাধ্যমের তথ্য যাচাই করার গতানুগতিক পদ্ধতি আর কাজ করবে না। এই গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের ফ্যাক্ট চেকিংয়ের ওপর নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের দরকার আছে। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন, ভুল তথ্য মোকাবিলা করার জন্য ফেসবুক এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মের জবাবদিহি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। সরকারকে প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে এবং তাদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু এগুলোর ওপর প্রভাব খাটানোর মতো অবস্থায় সরকার নেই। আগের সরকারের এসংক্রান্ত ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে অন্তর্র্বর্তী সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে।
ডিজিটালি রাইটের গবেষণা প্রধান তিতির আব্দুল্লাহ বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কিছু বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে। যেগুলোতে বিভিন্ন সংজ্ঞা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়নি বা এর অপব্যবহার রোধের জন্য কোনো সুরক্ষাব্যবস্থাও রাখা হয়নি।
অপতথ্য মোকাবিলায় ফ্যাক্ট চেকার ও সাংবাদিকদের নিয়ে অরাজনৈতিক একটি ফোরাম গঠনের সুপারিশ করেছে ডিজিটালি রাইট। ফ্যাক্ট চেকিং প্রশিক্ষণ জোরদারের পাশাপাশি ফ্যাক্ট চেকারদের সঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয় বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন আই সোশ্যালের চেয়ারপারসন অনন্য রায়হান, এফসিডিওর গভর্ন্যান্স অ্যাডভাইজার এমা উইন্ড, দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ এবং ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী।
বিকেপি/এমবি

