Logo

বিশেষ সংবাদ

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলেই নতুন দেশ

Icon

এম. ইসলাম

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:০১

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলেই নতুন দেশ

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন হলে গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষায় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও বাংলাদেশ বিনির্মাণ হবে। দলগুলোর ঐকমত্যে স্বাক্ষরিত আইনগত এই সনদ বিভাজনের রাজনীতি, ক্ষমতাচর্চা এবং ভিন্নমত দমনের আগ্রাসী মনোভাব থেকে বের হয়ে আসার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তাদের অনেকের প্রত্যাশা, আগামীদিনে যারাই ক্ষমতায় আসবে তারা সনদ বাস্তবায়ন করে দেশকে রাজনীতির ইতিবাচক ধারায় নিয়ে যাবে।

আবার অনেকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন। তাদের দাবি, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে কোনো দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে তারা আন্তরিক না হলে এটির বাস্তবায়নে শঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ সরকার আগামী সংসদকে সনদ বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা রাখেনি। 

এই ইস্যুতে অনেকেই ১৯৯০ সালের তিনদলীয় রূপরেখার উদাহরণ সামনে আনছেন। তাদের মতে, তিন দলের রূপরেখাকে সামনে এনেই স্বৈরাচার এরশাদ পতনের যে আন্দোলন করেছিল দলগুলো, পরবর্তীতে কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। বরং এরশাদ পতনের পর ক্ষমতায় আসা বিএনপির কর্মকাণ্ড ওই রূপরেখার বিপরীত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও ওই রূপরেখার আইনগত কোনো ভিত্তি ছিল না। তবে এবারের প্রেক্ষাপটও ভিন্ন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। নতুন বাংলাদেশে যারাই ক্ষমতায় আসবে তারা অন্তত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে। কারণ, এ বিষয়ে ঐকমত্যে তাদের স্বাক্ষর রয়েছে। পাশাপাশি জেন্টলমেন্ট এগ্রিমেন্টও আছে। কারণ, প্রধান সরকারের সিদ্ধান্ত তারা মনে নিয়েছে। তাই বিএনপি বা জামায়াত অন্য যে কেউ ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা সেটি বাস্তবায়ন করবে। শেখ হাসিনার পলায়নের দৃশ্য দেখে তারা আশা করি শিক্ষা নিয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের আন্দোলন শুরু হলেও পরবর্তীতে সেটি সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। যার নেপথ্যে ছিল নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ, ভিন্নমত দমন ও গুম-খুন ও হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারসহ নানা অপশাসন। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকেই রাজপথে নেমে এসেছিলেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।

এক পর্যায়ে আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (এনসিসি) গঠন করে। এরপর প্রায় নয় মাসে দুই দফায় ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ৬৭টি বৈঠকের পর দলগুলো ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ ঐকমত্য হয়। 

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে নানা বিতর্ক হলেও গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপি ও জামায়াতসহ ২৫টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা তাদের প্রস্তাবের সমন্বয়ে করা সনদে স্বাক্ষর করেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও চারটি বামদল সই থেকে বিরত থাকে। গত ২৮ অক্টোবর এনসিসি দলগুলোর প্রস্তাব তিন ভাগে ভাগ করে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়গুলো দ্রুত কার্যকরের প্রস্তাব দেয়। এ ছাড়া সংবিধান সংশ্লিষ্ট ৪৮টি বিষয় বাস্তবায়নে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’ জারি এবং একটি গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করারও প্রস্তাব দিয়েছিল এনসিসি।

এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে বিভেদের মধ্যেই বৃহস্পতিবার সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে। একইসঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন সনদের উল্লেখযোগ্য চারটি প্রশ্ন সংবলিত বিষয়ে একত্রে হাঁ/না ভোটের বিধান রেখে গণভোটের আদেশ জারি করা হয়েছে। হাঁ ভোটে পাস হলে আগামী সংসদ সেটি পাস করবে বলেও আদেশে বলা হয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ মনে করছেন, গণভোটে প্রশ্নে স্থান পাওয়া বিষয়গুলো প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়ন হলে আগামীদিন বাংলাদেশে নতুন কারো স্বৈরাচার হয়ে উঠার সুযোগ থাকবে না। মানুষ তার মৌলিক স্বাধীনতা ও ভিন্নমত পোষণের সুযোগ পাবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের আরেক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে যেন নতুন কোনো স্বৈরাচারের আর আর্বিভাব না হয় সে জন্য জুলাই সনদ বাস্তবায়ন জরুরি। কিন্তু সরকারকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় আরো শক্ত অবস্থানে থাকা উচিত ছিল।

তিনি বলেন, যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে তাহলে দলটি সনদের বাস্তবায়ন করবে বলে আমার মনে হয় না। দলটির বর্তমান নেতৃত্বের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, বিএনপির আগের শাসনামলের কথা মানুষ এখনো ভোলেনি। সরকারের আদেশে গণভোটের প্রশ্নের উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দুই কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠন, সংবিধান সংশোধনী করতে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদনকে স্থান দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া স্থান পেয়েছে, সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও কয়েকটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবু হেনা রাজ্জাকী মনে করছেন, একই দিনে গণভোট ও নির্বাচন নজিরবিহীন ঘটনা। সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটের প্রস্তাবগুলো হাঁ পাস হলেও কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে ক্ষমতায় এলে তারা বাস্তবায়ন না করলে কী হবে সেটি কিন্তু সরকারের আদেশে বলা নেই। এ ছাড়া গণভোট কিন্তু সংবিধানের অংশ তাহলে গণভোটে পাস হলে সেটি নিয়ে কেন আবার সংসদে যেতে হবে। সব মিলিয়ে এটির আইনি ভিত্তির বড় জটিলতা রয়েছে। তবে, নতুন বাংলাদেশ গড়তে এটি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

এদিকে, সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারির পর বড় দল বিএনপি এটিকে স্বাগত জানিয়েছে। জামায়াত ও এনসিপি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললেও কেউ প্রত্যাখ্যান করেনি। 

তাই, এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে তৈরি হওয়া শঙ্কা অনেকটাই দূর হয়েছে। ভোটের পরও দলগুলো সনদ বাস্তবায়নে ইতিবাচক ভাবনা নিয়ে সামনে এগিয়ে নতুন বাংলাদেশ দেখার স্বপ্ন পূরণ হবে বলে বেশির ভাগ মানুষের প্রত্যাশা।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

জুলাই সনদ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর