নভেম্বরেই শেষ হবে প্রশাসনিক সব নিয়োগ-রদবদল
তরিকুল ইসলাম সুমন
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৫৭
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জোরেশোরে চলছে প্রশাসনিক প্রস্তুতি। চলতি মাসের মধ্যে নির্বাচনের প্রাথমিক কাজ শেষ করতে চায় নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার লক্ষ্যে কাজ করছে কমিশন। নির্বাচনে মূল দায়িত্ব পালনকারী মাঠ প্রশাসন সাজানোর কাজও শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। চলতি মাসের মধ্যেই প্রশাসনিক সব নিয়োগ, পদায়ন ও রদবদল শেষ করতে চায় সরকার। তবে আগের তিনটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে কাজ করার ঘোষণা থেকে সরকারকে ফিরতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে অপেক্ষকৃত ভালো কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে চলতি মাসের মধ্যে মাঠ প্রশাসনে দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তা নিয়োগের কাজ সম্পন্ন করতে চায় সরকার। ইতোমধ্যে ৫২ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে ডিসি নিয়োগ নিয়ে সমালোচনা থেকে বের হতে পারছে না সরকার। আওয়ামী সরকারের মদদপুষ্ট কর্মকর্তাদেরও ডিসি করা হয়েছে, হয়েছেন পদায়নও, অনেকের আবার মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতাও নেই, কারো বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাদের মাঠে পাঠানো হচ্ছে, তারা নির্বাচনের আগে সংশ্লিষ্ট জেলায় ইতিবাচক ইমেজ বা ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে না পারলে ঝামেলায় পড়তে পারেন। নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেন প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসাররা। এ ছাড়া করেন কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। গত তিন নির্বাচনের প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদেরও কি বাদ রাখা হবে? তাহলে সরকার এত লোক কোথায় পাবে? আর তারা যদি এবারও দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে শুধু রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের বাদ দিয়ে কী লাভ হবে?
সূত্র জানায়, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কোনো কর্মকর্তাকে আসন্ন নির্বাচনে রাখা হবে না ঘোষণা দিয়েও সেই অবস্থানে থাকতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকার। সম্প্রতি তিন দফায় নিয়োগ দেওয়া ডিসিদের মধ্যে কেউ কেউ আগের নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসারের (এআরও) দায়িত্বে ছিলেন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনকে ভালো একটি জায়গায় নিতে পারেননি। এ প্রশাসন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই শেষ মুহূর্তে সরকার সুষ্ঠু ভোটের বিষয়টি মাথায় রেখে সঠিকভাবে প্রশাসন সাজানোর চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রেও খুব একটা সফল হতে পারছে না। সাম্প্রতিক নিয়োগ নিয়েও রয়েছে নানা সমালোচনা।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘নির্বাচনের যতটুকু সময় বাকি আছে এ সময়ে যদি যোগ্য ও চৌকস কর্মকর্তাদের ডিসি-ইউএনও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলেও নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। কারণ একজন যোগ্য ডিসি রাজনীতিবিদসহ কৌশলে সবাইকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন।’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভোটের আগে যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া সব ডিসিকে উঠিয়ে আনা হচ্ছে। এছাড়া যাদের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক নয় কিংবা যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে তাদেরও সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিন ধাপে ৫২ জেলায় পরিবর্তন আনা হলো। ভোটের আগে ডিসি পদে আরও পরিবর্তন আসতে পারে। তফসিলের আগে চলতি মাসের মধ্যেই প্রশাসনিক সব নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে। তফসিল ঘোষণার পরই সব দায়িত্ব চলে যাবে নির্বাচন কমিশনের ওপরে। তখনও ইসি চাইলে জনস্বার্থে যে কোনো কর্মকর্তাকে রদবদল বা পরিবর্তন করতে পারবে।
সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সব জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ও অফিসার ইনচার্জদের (ওসি) লটারির মাধ্যমে বদলি করা হবে। যে কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং ওসিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নির্বাচনের সময় দেখা যায়, প্রার্থীরা তাদের আসনে পছন্দের ডিসি, এসপি কিংবা ওসিকে পদায়ন করতে চান। এখন কর্মকর্তারা যেখানেই থাকুক না কেন নির্বাচনের আগে তাদের লটারির মাধ্যমে বদলি করা হবে।
পদায়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বর্তমানে ৬৪ জেলায় যারা পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের যোগ্যতার মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। একই সঙ্গে মূল্যায়নের মাধ্যমে এসপি পদে পদায়নের জন্য যোগ্য কর্মকর্তা বাছাই করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদের আসন্ন নির্বাচনে দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হবে।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে এমন কর্মকর্তা পাওয়া দুরূহ। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, গত তিন নির্বাচনে দায়িত্বে ছিলেন কিন্তু বড় ধরনের কোনো অভিযোগ নেই, এমন কর্মকর্তাদের রাখা হবে।
সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘ডিসি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দিলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়। এটাই সবচেয়ে বড় বিপদ। নির্বাচনকালীন ডিসিরা মাঠ প্রশাসনের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। তাদের নিরপেক্ষ ও পেশাদার আচরণের ওপরই নির্ভর করে নির্বাচনী পরিবেশের স্বচ্ছতা ও শান্তি। কিন্তু যদি দেখা যায়, আওয়ামী সুবিধাভোগীরা ও অদক্ষ কর্মকর্তারাই দায়িত্ব পাচ্ছেন, তাহলে জনগণের আস্থা নষ্ট হবে এবং প্রশাসন বিভক্ত হয়ে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে নির্বাচনের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার ওপরও। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এখনই এ ধরনের নিয়োগপ্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করা উচিত। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই মাঠ প্রশাসনে যারা দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন, তাদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।’
বিকেপি/এমবি

