অনুমোদন প্রক্রিয়াতেই গলদ দেখা দিল সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠাকালেই এর প্রস্তাবিত বোর্ড গঠন করা হলো কেবল আমলাদের দিয়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, গোড়ায় গলদ নিয়ে ব্যাংকটি সাফল্য পাবে কিনা সেই প্রশ্ন শুরুতেই সামনে এলো। কারণ, রাজনৈতিক বিবেচনায় পর্ষদ আর আমলাদের দুর্বল নেতৃত্বে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অবস্থা এখন নাজুক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকের বোর্ডে কারা থাকবে, না থাকবে সেটি সরকারের বিষয়।
জানা গেছে, প্রাথমিক লাইসেন্স পাওয়া ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ গঠনের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন জোগান হবে। এর জন্য প্রস্তাব দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। টাকা ছাড় করার জন্য অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। নতুন ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হিসাব খুললে সেই হিসাবে অর্থ বিভাগ টাকা ছাড় করবে।
তবে, নতুন ব্যাংকের সাত সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। এই পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক। পর্ষদের অন্য সদস্যরা হলেন অর্থ বিভাগের সচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব এম সাইফুল্লাহ পান্না, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামাল উদ্দিন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী, অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ রাশেদুল আমিন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব শেখ ফরিদ।
তবে, শুরুতেই গলদ দেখা দিল। ব্যাংকটির কাঠামো চলে গেল আমলাদের দখলে। যদিও, এখান থেকে আমলাদের আর বিদায় করা যাবে কিনা সে প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা। যদিও, নতুন এই ব্যাংকে সমানসংখ্যক স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হবে। তাদের মধ্যে পেশাদার ব্যাংকার, হিসাববিদ ও আইনজীবী থাকবেন বলে সূত্রগুলো বলছে। এ ছাড়া সার্চ কমিটির মাধ্যমে এমডিসহ শীর্ষ পর্যায়ের যোগ্য কর্মকর্তা নিয়োগের চিন্তা রয়েছে।
এর আগে পাঁচটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ নামে নতুন ব্যাংক গঠনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির প্রশাসক দল ইতোমধ্যে পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার দায়িত্ব নিয়েছে।
পাঁচ ব্যাংক হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, এক্সিম ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ছিল ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের এবং বাকি চারটি ছিল চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের কর্ণধার ও বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলমের নিয়ন্ত্রণে। তারা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকটির নাম নিবন্ধন করা হবে। এরপর চূড়ান্ত লাইসেন্স দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই ব্যাংক প্রথম পরিচালনা পর্ষদের সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকে হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত নেবে। সেই হিসাবে জমা হবে সরকারের দেওয়া মূলধনের টাকা। এর মধ্যে পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায় নতুন ব্যাংকটি অধিগ্রহণ করবে।
জানতে চাইলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সরকার ব্যাংকটির বোর্ডে কাদের রাখবে, না রাখবে সেটি তাদের এখতিয়ার। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো সিদ্ধান্ত নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক, কেবল সরকারের আবেদন যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে, অনুমোদন দেবে।
অর্থনীতিবিদ ড. তৌফিক আহমেদ গতকাল এ ব্যাপারে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, যতটা বিচার, বিশ্লেষণ করে মার্জার প্রক্রিয়া হাতে নেওয়া দরকার ছিলো সেটি হয়নি। বল প্রয়োগ করে কাজটি এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও গলদ তৈরি হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমলাদের দখল দিয়ে ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হলে, তাদের আর সরানো যাবে না। উল্টো নানা প্রক্রিয়ায় তারা ব্যাংকের পর্ষদে থেকে যাবে। এতে ব্যাংকটি সফল হবে না। তখন, বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা এতে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। আর ব্যাংকটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারবে না।
মার্জারের তালিকায় থাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মান্নানের নাম শোনা যাচ্ছিলো, তিনি নতুন ব্যাংকের চেয়ারম্যান হতে পারেন। এমন কথাও শোনা যায় তার নাম প্রস্তাব করে সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু শেষ পযন্ত সেটি হয়নি। যদিও, এখনো আব্দুল মান্নান, দৌড়ঝাপ করছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদে আসতে। মার্জার প্রক্রিয়ার শুরুতে তিনি বেশি তৎপর ছিলেন।
এদিকে, প্রস্তাবিত পাঁচ ব্যাংক মার্জার নিয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে, জনবল, প্রযুক্তি ও শাখা। প্রতিটি ব্যাংক আলাদা আলাদা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে, কোনটি নতুন ব্যাংকের জন্য বিবেচনা হবে তা চূড়ান্ত করতে হবে। তা ছাড়া শাখা বহাল ও স্থানান্তর করাটাও বেশ চ্যালেঞ্জ হবে। অবশ্য, প্রশাসকরা এসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে কাজ করছেন। একই সঙ্গে, ব্যাংকগুলোর লেনদেন স্বাভাবিক করতে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
বিকেপি/এমবি

