Logo

বিশেষ সংবাদ

স্বর্ণ চোরাচালানে তিন স্তরের সিন্ডিকেট

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১৯

স্বর্ণ চোরাচালানে তিন স্তরের সিন্ডিকেট

দেশে স্বর্ণ এখন শুধু অলঙ্কার নয়- এটি এক লাভজনক ছায়া-অর্থনীতির জ্বালানি। দেশে স্বর্ণের দাম, শুল্ক কাঠামো এবং আঞ্চলিক বাজারের পার্থক্যকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে শক্তিশালী স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট। বিমানবন্দর থেকে সীমান্ত, সীমান্ত থেকে শহরের অলিগলি, আর সেখান থেকে জুয়েলারি বাজার-এই পুরো চক্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ‘রিসিভার নেটওয়ার্ক’। তারা স্বর্ণটি গ্রহণ করে, আড়াল করে, বাজারে পৌঁছে দেয়। এদের নিয়ন্ত্রণেই সিন্ডিকেটের পূর্ণ চক্রটি চলমান থাকে।

বাংলাদেশের খবরের এক অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে স্বর্ণ চোরাচালান রিসিভার সিন্ডিকেটের নানা তথ্য।

চোরাচালান সিন্ডিকেট নেটওয়ার্ক বিভিন্নভাবে কাজ করে। চক্রটি মূলত দুই ধরনের রুট ব্যবহার করে। গালফভিত্তিক রুট : চাকরি শেষে দেশে ফেরা যাত্রীদের মাধ্যমে স্বর্ণ আনার চেষ্টা।

আরেকটি হচ্ছে প্রতিবেশী দেশের মূল্য-ফারাক কাজে লাগিয়ে স্বর্ণের ‘বিনিময় বাণিজ্য’ বা বার্টার ফর্মুলা। অবৈধ ডেলিভারির কেন্দ্রে বিমানবন্দর ও সীমান্তপথ বেছে নিচ্ছে।

তদন্তকারী সূত্র জানায়, স্বর্ণ লুকিয়ে আনার পদ্ধতি প্রতিনিয়ত পাল্টাচ্ছে। ব্যাগের সেলাই, বেল্টের ভেতর ফাঁক, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশের ভেতর, এমনকি যাত্রীদের দেহেও লুকিয়ে আনার চেষ্টা দেখা গেছে। সীমান্ত এলাকায় চোরাপথে ছোট-ছোট চালানে স্বর্ণ ঢোকে; যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হচ্ছে ডাস্ট রুট। আর এই স্বর্ণ চোরাচালান রিসিভাররা পুরো সিন্ডিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিংক।

তাদের কাজ হচ্ছে বিমানবন্দর বা সীমান্তে আগে থেকেই উপস্থিত থাকা, চালান পৌঁছামাত্র স্বর্ণ সংগ্রহ, ঝুঁকিমুক্ত এলাকায় দ্রুত স্থানান্তর। পরবর্তী পর্যায়ের ডিলার বা বাজার খুচরা নেটওয়ার্কে সরবরাহ করা। এদের বেশিরভাগই পেশাদার। কেউ কেউ আবার স্বর্ণ ব্যবসায়ী পরিচয়ের আড়ালে বহু বছর ধরে সক্রিয়।

এদের গন্তব্য হচ্ছে দেশের নামিদামি জুয়েলারি বাজার ও মানি সার্কিট। কিছু বৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে অনেকের বিরুদ্ধেই অবৈধ স্বর্ণ গলিয়ে বাজারে ছাড়ার অভিযোগ আছে।

সংশ্লিষ্ট আর্থিক লেনদেন সাধারণত নগদে এবং একাধিক ‘মধ্যমানুষ’-এর মাধ্যমে হয়-যাতে ট্রেস করা কঠিন হয়।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভিযান চালিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের কথিত ‘রিসিভার’ নূরুল আলমকে (৩০) আটক করেছে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। গত শনিবার দুপুর ২টা ২০ মিনিটের দিকে বিমানবন্দরের বহুতল কার পার্কিংয়ের নিচতলায় তাকে আটক করা হয়।

এপিবিএন জানায়, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে নূরুল আলম পালানোর চেষ্টা করলে তাকে ধাওয়া করে আটক করা হয়। পরে এপিবিএন অফিসে নিয়ে তল্লাশি চালিয়ে তার গলায় ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ, পরিহিত জুব্বা এবং পায়জামার পকেট থেকে ১৩০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার ও ১৩,৯৭০ সৌদি রিয়াল উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার স্বর্ণের মান ২১, ২২ এবং ২৪ ক্যারেট।

জিজ্ঞাসাবাদে নূরুল আলম জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে অজ্ঞাতনামা যাত্রীরা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে স্বর্ণ দেশে আনে, আর তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দরে ওই চোরাচালান সিন্ডিকেটের রিসিভার হিসেবে কাজ করছেন।

এপিবিএনের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক জানান, চলতি বছরে এপিবিএন এ পর্যন্ত ২৮ কেজি ৫০৮.৩৮ গ্রাম সোনা জব্দ করেছে। বিমানবন্দর এলাকায় চোরাচালান রোধে নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করছি। সোনা ও মাদক চোরাচালানের তৎপরতা প্রতিহত করতে এপিবিএন সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রেখেছে। বিমানবন্দর ব্যবহার করে কোনো ধরনের চোরাচালান হতে দেওয়া হবে না।

গত দুই বছরে বিমানবন্দর ও সীমান্তে প্রায় প্রতিনিয়ত এভাবে স্বর্ণ জব্দের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে পরিমাণ ধরা পড়ছে, তা মোট চোরাচালানের খুব সামান্য অংশ। রিসিভার নেটওয়ার্ক অক্ষত থাকায় সিন্ডিকেট ভাঙা কঠিন।

একাধিক সূত্র বাংলাদেশের খবরকে জানায়, অভিযানের পরও এদের দমন করা কঠিন। কারণ এই চোরাচালানকারীদের পদ্ধতি প্রতিনিয়ত দ্রুত পাল্টায়। রিসিভার নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলা না গেলে চক্রের ‘ডিমান্ড’ থাকে। এছাড়া এদের নগদ অর্থ লেনদেন ট্রেস করা কঠিন। রাজধানীর কয়েকটি বাজারে অবৈধ স্বর্ণ ঢোকানোর অঘোষিত ‘রুটিন’ তৈরি আছে বলেও জানা যায়।

 

এই সিন্ডিকেটের রয়েছে তিনটি স্তর : প্রথম স্তর হচ্ছে অপারেটর-কারিয়ার চোরাচালান কারিয়াররা সাধারণত নিম্ন-মধ্য আয়ের পেশাজীবী, বিদেশফেরত শ্রমিক বা সীমান্ত এলাকার ‘পরিচিত মুখ’, তারা অল্প টাকায় ঝুঁকি নেয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে রিসিভার হ্যান্ডলার (সিন্ডিকেটের মেরুদণ্ড)। এরা সাধারণত শহুরে ‘কলেক্টর’ ব্যবসায়িক প্রভাবশালী ব্যক্তি, স্থানীয় দালাল বা লেনদেন নিয়ন্ত্রক। দ্রুত পরিবহনের জন্য এরা আলাদা গাড়ির ব্যবস্থা করে রাখে। এদের রয়েছে চোখে না পড়া লুকানোর জায়গা। নগদ অর্থের বড় প্রবাহ আর ক্রমাগত ‘নতুন যোগাযোগ’ তৈরির সক্ষমতা রয়েছে এই চক্রটির। এ ছাড়া বাজার-ইন্টিগ্রেটররা অবৈধ স্বর্ণকে বৈধ বাজারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। এদের রয়েছে অবৈধ গলন চুল্লি, তৈরি করে কৃত্রিম বিল আর বানায় ভুয়া ওজন স্লিপ। এগুলো ব্যবহার করে স্বর্ণটিকে বৈধতার ছায়া দেওয়া হয়।

শুধুমাত্র এই চক্রটির কারণে রাজস্ব, নিরাপত্তা, স্বর্ণের বৈধ ব্যবসা তিন দিকেই ধস নামছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক ও কাস্টমসের রাজস্ব ক্ষতি, কোটি কোটি টাকা হারাচ্ছে রাষ্ট্র। বৈধ জুয়েলারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  বৈধ স্বর্ণের বাজারের মূল্য নষ্ট করছে। এছাড়া অর্থপাচার ঝুঁকি বাড়ছে। স্বর্ণ চোরাচালান প্রায়শই অবৈধ হুন্ডি ও আন্ডারগ্রাউন্ড মানি ফ্লো-এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।

যেসব পথ থেকে দেশে অবৈধভাবে স্বর্ণ ঢোকে, এর একটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। অবৈধ স্বর্ণ জব্দের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় প্রায়ই মামলা হয়। জানা গেছে, কিছু বাহক রয়েছে, যারা নিয়মিত চোরাই স্বর্ণ আনা-নেওয়া করে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছেন এমন অনেক প্রবাসীকে চোরাকারবারিরা টোপ দেয়- স্বর্ণের বার বহনের বিনিময়ে বিমানে দেশে আসা-যাওয়ার টিকিট খরচ তারা বহন করবে। আবার পেশাদার যারা এ কারবারে জড়িত, বাহক হিসেবে তারা প্রতি চালানের জন্য ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পায়। পাচারকারীরা অবৈধ মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার করে। নাম-পরিচয়হীন এসব সিম নম্বর তাদের কাছে সরবরাহের জন্য আছে আলাদা গ্রুপ। সাধারণত ফেনী, নারায়ণগঞ্জ,,চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দাদের বাহক হিসেবে বেশি ব্যবহার করছে চক্রের সদস্যরা।

নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গোয়েন্দা নজরদারি আরও সমন্বিত করতে হবে। একাধিক সংস্থায় আলাদা তথ্য থাকলেও তা সমন্বিত না হওয়ায় বড় চক্র ধরা পড়ে না।

রিসিভারদের শনাক্ত করতে প্রয়োজন আর্থিক লেনদেন বিশ্লেষণ, বাজারমুখী নজরদারি, সন্দেহজনক ‘দ্রুত নগদ প্রবাহ’-এর ওপর কঠোর মনিটরিং। সীমান্ত-বিমানবন্দর-বাজার : তিনমুখী নিরাপত্তা চেইন শক্ত করতে হবে।

স্বর্ণ চোরাচালান শুধু অপরাধ নয়- এটি দেশের বৈধ অর্থনীতি, বাজার কাঠামো, এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্য বড় হুমকি।

এই নেটওয়ার্ক ভাঙতে হলে প্রথম লক্ষ্য হতে হবে রিসিভারদের ধরতে সক্ষম একটি সুসংগঠিত, তথ্যনির্ভর, দ্রুতগতির নজরদারি ব্যবস্থা।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

স্বর্ণের দাম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর