কফিনবন্দি হয়ে ফিরলেন হাদি
থেমে গেল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর
হাসান রাজীব
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৪২
চব্বিশের জুলাইয়ের অন্যতম আপোসহীন বিপ্লবী, ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা, সময়ের সাহসী কণ্ঠস্বর শরিফ ওসমান বিন হাদি। সফলতার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছেও শুধু একটি গুলির বিপরীতে সপ্তাহজুড়ে লড়াই শেষে রেখে গেলেন সাহস, প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের এক জ¦লন্ত স্বাক্ষর। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অকুতোভয় এই বীর, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র এবং ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদি এবার সিঙ্গাপুরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসিমুখে চলে গেলেন পরওয়ারদিগারের দরবারে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ বাদজোহর সংসদ ভবন এলাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে তার জানাজা হবে। পরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে বলে জানিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। ওসমান হাদির মৃত্যুতে আজ রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে তার মরদেহ বহনকারী বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিজি-৩৮৫ ফ্লাইটটি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। বিমানবন্দরের ক্যান্টনমেন্ট গেট দিয়ে থেকে বের হয়েছে হাদির মরদেহ।
এর আগে বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ৩ মিনিটে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে (এসজিএইচ) হাদির মৃত্যু হয়। রাতেই ইনকিলাব মঞ্চ ও হাদির ভেরিফায়েড ফেসবুবক পেজে দেওয়া পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়।
বিমানবন্দর থেকে হাদির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হতে পারে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হিমঘরে। রাতে সেখানেই রাখা হবে কফিন।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘হাদির মরদেহ এখানে রাখার ব্যাপারে আপাতত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তারা আমাদের বলার পর আমরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি।’ তবে এটার পরিবর্তনও হতে পারে বলে আভাসও দিয়েছেন তিনি।
কবি নজরুলের পাশে হবেন সমাহিত: পরিবারের দাবির ভিত্তিতে ওসমান হাদিকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে বলে জানিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজে বলা হয়, শহীদ ওসমান হাদিকে বহনকারী গাড়িটি বিমানবন্দর থেকে হিমাগারের উদ্দেশে যাত্রা করে। সেখানে মরদেহ রেখে শাহবাগে অবস্থান নেবে ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীরা।
পরিবারের দাবির ভিত্তিতে শহীদ ওসমান হাদিকে কবি নজরুলের পাশে সমাহিত করার এবং আজ শনিবার সংসদ ভবন এলাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বাদ জোহর জানাজার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের পরিবর্তে মিছিলসহ হাদির মরদেহ আগামীকাল সেন্ট্রাল মসজিদে আনা হবে। ছাত্রজনতা আজ ও আগামীকাল শৃঙ্খলার সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, যাতে কোনো গোষ্ঠী অনুপ্রবেশ করে আন্দোলন স্তিমিত করতে না পারে এবং সহিংসতার সুযোগ না পায়। মরদেহ দেখার কোনো সুযোগ থাকবে না। সবার কাছে শৃঙ্খলা বজায় রাখার এবং শহীদ ওসমান হাদির জন্য দোয়া পৌঁছানোর অনুরোধ করা হচ্ছে। এদিকে ওসমান হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে গভীর শোকের আবহ তৈরি হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শোক: ওসমান হাদির মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত বৃহস্পতিবার রাতে এক শোক বাতায় রাষ্ট্রপতি ও জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক একটি সংবাদ নিয়ে। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখভাগের অকুতোভয় যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদি আর আমাদের মাঝে নেই। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিউন)।
তিনি আরও বলেন, কিছুক্ষণ আগে সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান আমাকে টেলিফোনে এই হৃদয়বিদারক সংবাদটি জানিয়েছেন। ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী সংগ্রামের এই অমর সৈনিককে মহান রাব্বুল আলামিন শহীদ হিসেবে কবুল করুন, এই দোয়া করি। শরিফ ওসমান বিন হাদির এই অকাল মৃত্যুতে আমি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি।
এছাড়া হাদির মৃত্যুর পর শোক জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দল। ফেসবুকের ভেরিফায়েড আইডি থেকে পোস্ট করেছেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম। এই মৃত্যুর ঘটনায় শোক জানিয়েছে বিএনপি ও জামায়াত।
সারা দেশে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ: ওসমান হাদির মৃত্যুতে সারা দেশে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছে। মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা উত্তাল হয়ে ওঠে। তার মৃত্যুর খবরে দেশের যেসব স্থানে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করা হয় সেগুলো হলো- ঝালকাঠি, রংপুর, নীলফামারী, ল²ীপুর, বরিশাল, দিনাজপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, ফটিকছড়ি, পিরোজপুর, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন এলাকা।
বিক্ষোভকারীরা হাদির হত্যার দায়ীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। তারা বলেন, শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যু ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের প্রতীক হয়ে থাকবে। দেশের মানুষ আর এসব নৃশংসতা মেনে নেবে না।
ওসমান হাদির মৃত্যুতে ‘লং মার্চ টু বর্ডার’: ওসমান হাদির মৃত্যুর প্রতিবাদে বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট জিরো পয়েন্ট বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্র জনতা। এসময় তারা হাদির খুনিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার ও নাগরিকদের নিরাপত্তা জোরদার করার দাবিও জানান। গতকাল বেলা ১১টায় বেনাপোল পৌর শহরের বাজার হতে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়ে ‘লং মার্চ টু বর্ডার’ বেনাপোল চেকপোস্ট জিরো পয়েন্টে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
বিক্ষোভকারীরা এ সময় ‘তুমি কে আমি কে, হাদি হাদি’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে?’ ‘ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। এবং ওসমান হাদির স্বপ্ন পূরণে শেষ রক্তবিন্দু অব্দি রাজপথে থাকার ঘোষণা দেন জুলাই যোদ্ধারা। বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দেন ছাত্র-জনতা আন্দোলনের আহবায়ক সাবেক শিক্ষক আ. মান্নান।
সহিংসতা পরিহারের অনুরোধ ইনকিলাব মঞ্চের: সাধারণ জনগণকে যেকোনো ধরনের সহিংসতা পরিহারের অনুরোধ জানিয়েছে ওসমান হাদির ইনকিলাব মঞ্চ। হাদির মৃত্যুর সংবাদে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের পাশাপাশি হামলা-ভাঙচুরের ঘটনার পর ইনকিলাব মঞ্চের ফেসুবক পেজ ও হাদির পেজ থেকে এ অনুরোধ জানানো হয়।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘ওসমান হাদি তার শত্রæর সঙ্গেও আমৃত্যু ইনসাফ চেয়েছেন, বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করতে চেয়েছেন। যিনি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নিজের জীবনটা পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছেন, তাকে কেন্দ্র করে যাতে কোনোভাবেই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন না হয় সেদিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখবার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি নির্বাচন করার জন্য প্রচার চালাচ্ছিলেন। গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট সড়কে তাকে গুলি করা হয়। মাথায় গুলিবিদ্ধ হাদিকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে নেওয়া হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। গত সোমবার দুপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ওসমান হাদিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সঙ্গে তার ভাই ছাড়াও বাংলাদেশি চিকিৎসক ও নার্সরা গিয়েছিলেন।
সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ১২ ডিসেম্বর দুপুর ২টা ২৫ মিনিটের দিকে হাদিসহ দুজন একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় যাচ্ছিলেন। তখন মোটরসাইকেলে আসা ব্যক্তিরা তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। তখনই চিকিৎসকরা জানান, তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। তাকে লাইফ সাপোর্টে রেখে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গুলির খণ্ডিতাংশ বের করা হয়। সন্ধ্যায় তাকে স্থানান্তর করা হয় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে। সেখান থেকে ১৫ ডিসেম্বর তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়।
বিকেপি/এমবি

